রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চার নীতি

বিগত প্রশ্নঃ ২৫তম ও ৩২ তম বিসিএস

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে বর্ণিত হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। এখানে ৮ম অনুচ্ছেদ থেকে ২৫শ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিধৃত হয়েছে। মূলনীতিগুলোর প্রধান চারিটি আছে ৯ম থেকে ১২শ অনুচ্ছেদে।

৯ম অনুচ্ছেদ-জাতীয়তাবাদঃ ভাষা ও সংস্কৃতির ঐক্য ও সংহতি হবে বাঙলী জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি।

১০ম- সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তিঃ মানুষকে অন্য মানুষের শোষণ হতে মুক্ত করে সাম্যবাদী ও ন্যায়ানুগ সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্টা করা হবে।

১১শ – গণতন্ত্র ও মানবাধিকারঃ প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।

১২শ-ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতাঃ (ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে।

এই চারটি মূলনীতি এখন যে নামে যে অবস্থায় আছে, ৭২ এর সংবিধানেও অনুরূপভাবে ছিল। এতে প্রথম পরিবর্তন আসে ৭৫ এর চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। যেখানে গণতন্ত্রকে তিরোহিত করে, এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তারপর পঞ্চম সংশোধনীতে পরিবর্তন করা হয়, অপর তিন মৌলিক নীতিতে। সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র’ প্রতিস্থাপন করা হয়। ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘ মহান আল্লাহতালার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযোজন করা হয়। ও ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ কে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২ এর চার মূলনীতের ফিরে যাওয়া হয়।

প্রসঙ্গ কথাঃ চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি আমাদের সংবিধানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ।এগুলো হলো রাষ্ট্রের মতাদর্শিক স্তম্ভ এবং সেই সঙ্গে গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের স্মারক।বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনায় চারটি মূলনীতির কথা বলা আছে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা। এই চার মূলনীতির কথা এককভাবে ৮ম অনুচ্ছেদে ও বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া এই চার মূলনীতি আলাদা আলাদা ভাবে ৯ম, ১০ম, ১১শ ও ১২শ অনুচ্ছেদে ও বর্ণনা করা হয়েছে।

জাতীয়তাবাদঃ একাত্তরে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, কয়েক লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো ওই সংগ্রামেরই অর্জন। শুরুতে, যুদ্ধকালে, মূলনীতি ছিল তিনটি: ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। জাতীয়তাবাদ যুক্ত হয়েছে যুদ্ধজয়ের পরে। প্রথমে জাতীয়তাবাদ যুক্ত করা হয়নি এ কারনে যে স্বাধীনতা তো আত্মস্বীকৃত ও ঘোষিত রূপেই ছিল জাতীয়তাবাদী।

গণতন্ত্রঃ পাকিস্তানে গণতন্ত্রের নাম-নিশানা ছিল না। সেখানে শাসন ছিল পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক; কখনো কখনো অসামরিক, সরাসরি সামরিকই ছিল বড় একটা সময়জুড়ে। এটা তো জানা সত্য যে প্রকৃত গণতন্ত্র ভোটের চেয়ে বেশি; সে গণতন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে নাগরিকদের অধিকার ও সুযোগের সাম্য, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব। যথার্থ গণতন্ত্র তো ছিলই না, ভোটের গণতন্ত্রও দেখা যায়নি। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে কোনো সাধারণ নির্বাচন হয়নি, শেষমেশ যখন হলো তখন রাষ্ট্র নিজেই গেল দুই টুকরো হয়ে। গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তও কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতাই।

ধর্মনিরপেক্ষতাঃ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের শুরুই হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে। দ্বিজাতিতত্ত্বটা ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ওপর নির্ভরশীল। বাঙালিরা সেটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে দেখে পাকিস্তানি হানাদারেরা ক্ষিপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত উন্মাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ঘা লেগেছিল তাদের স্বার্থে। তারস্বরে তারা ঘোষণা করেছিল, ইসলামকে রক্ষা করবে; ইসলাম রক্ষা আর পাকিস্তান রক্ষা তাদের কাছে একাকার হয়ে গিয়েছিল। হানাদারদের যারা পালের গোদা, সামরিক বাহিনীর মস্ত মস্ত বীরপুরুষ, তারা ধর্মকর্মের জন্য বিখ্যাত ছিল না। নিজেদের শৌর্যবীর্য তারা ধর্মাচরণের ভেতর দিয়ে প্রদর্শিত করেনি। পাকিস্তানি জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নামাজ পড়তেন বলে জানা যায় না; রোজার মাস কখন আসে কখনই বা বিদায় নেয়, তার খবর যে রাখতেন না এমন প্রমাণ আছে। অখণ্ড পাকিস্তান রাষ্ট্রের শেষ প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বিশেষ খ্যাতি জঙ্গের ময়দানে যতটা না প্রকাশ পেয়েছে, ততোধিক ধরা পড়েছে মদ্যপানের আসরে। কিন্তু ওই রাষ্ট্রনায়কেরা কেউই রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করতে কার্পণ্য করেননি। ধর্মকে তাঁরা ব্যবহার করেছেন ধর্মের স্বার্থে নয়, নিজেদের স্বার্থেই। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূত্রপাতই হয়েছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে নাকচ করে দিয়ে। বাংলাদেশের মানুষ হানাদারদের চেয়ে বেশি ধার্মিক; কিন্তু ধর্ম ও রাষ্ট্রকে তারা কখনোই একাকার করে ফেলতে চায়নি। আলাদা করে রাখতে চেয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যে উৎসাহী হয়েছিল, সেটাও ধর্মের প্রয়োজনে নয়, ইহজাগতিক প্রয়োজনেই।

সমাজতন্ত্রঃ যাকে প্রকৃত গণতন্ত্র বলছি, সেটার অর্জন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া সম্ভব নয়। তার কারণ, সম্পত্তির সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা না করলে অধিকার ও সুযোগের সাম্য আসে না; ধনবৈষম্য বহুবিধ বৈষম্যের আকর হয়ে দেখা দেয়।

বর্তমান অবস্থাঃ একদিকে ঘটেছে উন্নতি, অন্যদিকে অবনতি। যেমন ঢাকা শহরে প্রচুর মোটরগাড়ি এসেছে, কিন্তু তাতে শহরের বাসিন্দাদের চলমানতা বাড়েনি, উল্টো কমেছে। দেশে কেউ কেউ ধনী হয়েছে, ইতিমধ্যে বিশ্বমানের অন্তত একজন ধনীর সন্ধান পাওয়া গেছে, অচিরেই তাদের সংখ্যা বাড়বে। এর বিপরীতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। দুর্নীতিতে আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছি, বায়ুদূষণে ঢাকা সারা পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতি অত্যন্ত উজ্জ্বল, কিন্তু নারী নির্যাতনের মাত্রা ক্রমাগত নিষ্ঠুরতর হচ্ছে। শিক্ষিতের হার বাড়ছে; কিন্তু তিন ধারার শিক্ষা তিন দিকে ছুটছে। আধুনিকতা বেপরোয়া হতে চাইছে, আবার হেফাজতিরাও বেগে ধেয়ে আসছে। পুঁজিবাদী এই উন্নতির পক্ষে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোর সঙ্গে শত্রুতা না করে উপায় নেই; এবং সেটাই সে নিয়মমাফিকই করে চলেছে। মূলনীতিগুলোর দুর্দশা সামাজিক দুর্দশারই প্রতিচ্ছবি। উন্নতির নিচে চাপা পড়ে নিঃশব্দে ক্রন্দন করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

Add a Comment