ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ – ২৯ জুলাই ১৮৯১) উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার। তিনি পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা নামে স্বাক্ষর করতেন। ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তাঁর নামের সঙ্গে ‘বিদ্যাসাগর‘ উপাধিটি ব্যবহৃত হয়। বদান্যতার জন্য তাকে ‘দয়ারসাগর‘, উপাধি দেওয়া হয়। তিনি ‘মানবত্রাতা‘ উপাধি ও পান। ১৮৪১ সালে ফোর্টউইলিয়াম কলেজের প্রধান পন্ডিত নিযুক্ত হন। ১৯৫১ সালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে উন্নীত হন।

সংস্কার আন্দোলন
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ সালে সরকার বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি ২০ টি মডেল কলেজ ও ৩৬ টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। নারী শিক্ষা বিস্তারে নারী শিক্ষা মন্দির ‘বেথুন কলেজ’ প্রতিষ্ঠায় তাঁর ব্যাপক অবদান রয়েছে।

সাহিত্যে অবদান
তিনিই প্রথম ‘বাংলা গদ্যের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা আবিষ্কার করেন এবং গদ্য ভাষায় যতি চিহ্নাদি যথাযথভাবে প্রয়োগ করেন। ফলে তাঁর গদ্য হয়ে ওঠে শৈলীসম্পন্ন। এজন্য তাঁকে বলা হয় বাংলা গদ্যের জনক।’ বাংলা বর্ণসমূহ সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে শিশুদের বাংলা বর্ণমালার প্রথম সার্থক গ্রন্থ ১৮৫৫ সালে লেখা তাঁর ‘বর্ণ পরিচয়’। এ গ্রন্থ আজও বাংলা ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে দিকনির্দেশক।

মৌলিক গ্রন্থ
সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩, বাংলায় লেখা সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস ।)
বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫)
বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৭১)
অতি অল্প হইল (১৮৭৩)
আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩)
ব্রজবিলাস (১৮৮৪)
রত্নপরীক্ষা (১৮৮৬)
প্রভাবতী সম্ভাষণ ( ১৮৬৩ বন্ধুর মেয়ের অকাল মৃত্যুতে রচিত। বাংলা সাহিত্যের প্রথম শোকগাঁথা। )
জীবন-চরিত (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত, বাংলা সাহিত্যের প্রথম আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। ) (৩৮তম বিসিএস প্রিলিমিনারি)
শব্দমঞ্জরী (১৮৬৪)
নিষ্কৃতি লাভের প্রয়াস (১৮৮৮)
ভূগোল খগোল বর্ণনম্ (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত)

শিক্ষামূলক গ্রন্থ
বর্ণপরিচয় (১ম ও ২য় ভাগ ; ১৮৫৫)(বইটি ক্লাসিক মর্যাদা পেয়েছে। )
ঋজুপাঠ (১ম, ২য় ও ৩য় ভাগ ; ১৮৫১-৫২)
সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১)
ব্যাকরণ কৌমুদী (১৮৫৩)
বোধোদয়
কথামালা

অনুবাদ গ্রন্থ

হিন্দি থেকে বাংলা
বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭ ; লাল্লুজি কৃত বেতাল পচ্চীসী অবলম্বনে রচিত। এবং এই বইয়ের দশম সংস্করণে প্রথম বিরাম চিহ্নের সফল ব্যাবহার করা হয়েছে। ) এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। এর আগে তিনি ভাগবতের কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে ‘বাসুদেব চরিত’ রচনা করেছিলেন। তবে এটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি তাই প্রকাশ হয় নি।

সংস্কৃত থেকে বাংলা
শকুন্তলা (ডিসেম্বর, ১৮৫৪ ; কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ অবলম্বনে)
সীতার বনবাস (১৮৬০ ; ভবভূতির উত্তর রামচরিত ও বাল্মীকি রামায়ণ-এর উত্তরাকান্ড অবলম্বনে)
মহাভারতের উপক্রমণিকা (১৮৬০ ; ব্যাসদেব মূল মহাভারত-এর উপক্রমণিকা অংশ অবলম্বনে)
বামনাখ্যানম্ (১৮৭৩ ; মধুসূদন তর্কপঞ্চানন রচিত ১১৭টি শ্লোকের অনুবাদ)
ইংরেজি থেকে বাংলা
বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮ ; মার্শম্যান কৃত হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল অবলম্বনে রচিত)
জীবনচরিত (১৮৪৯ ; চেম্বার্সের বায়োগ্রাফিজ অবলম্বনে রচিত)
নীতিবোধ (প্রথম সাতটি প্রস্তাব – ১৮৫১ ; রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্সের মরাল ক্লাস বুক অবলম্বনে রচিত)
বোধোদয় (১৮৫১ ; চেম্বার্সের রুডিমেন্টস অফ নলেজ অবলম্বনে রচিত)
কথামালা (১৮৫৬ ; ঈশপস ফেবলস অবলম্বনে রচিত)
চরিতাবলী (১৮৫৭ ; বিভিন্ন ইংরেজি গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা অবলম্বনে রচিত)
ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬১ ; শেক্সপিয়রের কমেডি অফ এররস অবলম্বনে রচিত)

‘আখ্যানমঞ্জরী’(১৮৬৮ বিশ্বের নানা দেশের ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্যক্তির জীবনের গৌরবদীপ্ত ঘটনাই এ গ্রন্থের বিভিন্ন রচনার উপজীব্য।)

সম্পাদিত পত্রিকার নামঃ সর্বশুভকরী

নীল দর্পণ নাটক বাংলার পেশাদার থিয়েটার গড়ার ক্ষেত্রেও অবদান রেখেছিল। এই নাটক দিয়ে প্রভাবিত হয়েই গীরিশচন্দ্র ঘোষ কোলকাতায় ন্যাশনাল থিয়েটার গঠন করেন এবং নীল দর্পণই প্রথম বানিজ্যিকভাবে প্রদর্শিত হয়। এই নাটকের প্রদর্শনীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও উপস্থিত ছিলেন দর্শক হিসাবে। আবেগী এবং মেজাজী লোক ছিলেন তিনি। সাহেব সুবোদের গ্রাহ্যের মধ্যেই নিতেন না। অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য এক ইংরেজ অধ্যক্ষ্যের সামনে টেবিলে পা তুলে দিয়ে কথাও বলেছিলেন একবার। কারণ, ওই অধ্যক্ষ বৃটিশ হবার গরিমায় ঈশ্বরচন্দ্রের সাথে একই আচরণ করেছিলেন। নাটকের মূল চরিত্র উডের ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন শক্তিমান অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। নীল চাষীদের উপর তাঁর অত্যাচারের অভিনয় দেখে বিদ্যাসাগর এতই ক্ষিপ্ত হয়ে ছিলেন যে, পায়ের জুতো খুলে ছুঁড়ে মেরেছিলেন অর্ধেন্দুর গায়ে। তিনিও তাঁর অভিনয়ের পুরস্কার হিসাবে সেই জুতোকে তুলে নিয়েছিলেন স্মারক হিসাবে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ২৯ জুলাই ১৮৯১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

  • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করুন। (৩৬তম বিসিএস লিখিত)
  • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রকৃত নাম কী? কোন প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন? (৩৪তম বিসিএস লিখিত)
  • বাংলা গদ্যের জনক কে? তাঁকে কেন বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়? (৩৩, ২৯তম বিসিএস লিখিত)
  • বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিদ্যাসাগরের অবদান নির্দেশ করুন। (৩১তম বিসিএস লিখিত)
  • সাহিত্যকর্ম ও সমাজকর্ম এ দুইয়ের মধ্যে কোনটির জন্যে বিদ্যাসাগর অধিক সুপরিচিত? আপনার অভিমত ব্যক্ত করুন। (২৮তম বিসিএস লিখিত)
  • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ কী এবং এটি কত সালে প্রকাশিত হয়। (২৭তম বিসিএস লিখিত)
  • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত ‘ভ্রান্তি বিলাস’ ইংরেজি কোন বইয়ের অনুবাদ? (২৫তম বিসিএস লিখিত)
  • বেতাল পঞ্চবিংশতি কার লেখা? (২৫তম বিসিএস লিখিত)
  • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ বিষয়ক গ্রন্থটির নাম লিখুন। (১৮তম বিসিএস লিখিত)
  • বাংলা গদ্যের জনক বলা হয় কাকে? বাংলা গদ্যে তিনি কী সংযোজন করেন? (১৫তম বিসিএস লিখিত)
  • শেক্সপীয়র রচিত কোন নাটকটি বিদ্যাসাগর অনুবাদ করেন? এবং অনূদিত বাংলা গ্রন্থটির নাম কী? (১৩তম বিসিএস লিখিত)