ট্রাম্পের প্রস্থানে কাবু হবে কট্টর ইরানিরা?

প্রথম আলো, ২২ মে ২০১৮
ইংরেজি থেকে অনূদিত
আব্বাস ফয়েজ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ


ইরান চুক্তি থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেরিয়ে আসার ঘোষণা বহু বিশ্লেষকের পর্যবেক্ষণকে ভুল প্রমাণ করেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ট্রাম্পের ঘোষণা ইরানকে এই চুক্তি থেকে শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে যেতে প্ররোচিত করতে পারেনি। ট্রাম্পের ঘোষণার কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস আগে থেকে বেশির ভাগ বিশ্লেষক অন্তত দুটি বিষয়ে একমত হয়েছিলেন।

প্রথমটি হলো, ট্রাম্পের এই ঘোষণায় পরমাণু চুক্তিটি পুরোপুরি বানচাল হয়ে যাবে এবং পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতার পাল্টাপাল্টি হুমকি-ধমকিতে মধ্যপ্রাচ্যে আগের চেয়ে বেশি অস্থিরতা নেমে আসবে।

দ্বিতীয়টি হলো, ট্রাম্পের এই ঘোষণার কারণে ইরানে সেখানকার উদারপন্থী সংস্কারবাদীদের ওপর কট্টরবাদীদের চাপ অনেক বেড়ে যাবে।

এই দুটি অনুসিদ্ধান্তে প্রায় সব বিশ্লেষকই একমত ছিলেন। ইরানের কট্টরপন্থীরা দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সমর্থন পাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই কট্টরবাদীরা পশ্চিমাদের ঘোর বিরোধী। তারা ইসলামের কিছু অনুশাসন কাঁটায় কাঁটায় মেনে চলা ও সমাজে বাস্তবায়ন করার পক্ষে। তারা ইরানের শিয়া বিপ্লবের বার্তা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অপরদিকে, উদারপন্থীরা প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির শিবিরের লোক। তারা পশ্চিমা সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায় এবং ইসলামি অনুশাসন ব্যক্তিজীবনে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক উদার।

ট্রাম্পের ঘোষণার পর দেখা গেল ইরানের সংস্কারপন্থী ও কট্টরবাদী—উভয় শিবিরই চুক্তিতে বহাল থাকার পক্ষে মত দিয়েছে। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্য দেশ ও সংগঠন ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, রাশিয়া, চীন ও ইইউ চুক্তিতে অনড় থাকবে বলে জানিয়েছে।

ইরানের সংস্কারপন্থীদের চুক্তি অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দেওয়ায় চমকানোর কিছু নেই। কারণ, একসময় তারাই এই চুক্তি করার বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিল এবং এটি টিকিয়ে রাখতে তারাই সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিল। কট্টরপন্থীদের গল্প আবার ভিন্ন। পূর্বপরিকল্পনাই হোক আর দুর্ঘটনাবশতই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি ছেড়ে যাওয়ার পরও চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কট্টরপন্থীদের চুক্তি সমর্থন করা ছাড়া কোনো পথ নেই। যেকোনো অসহযোগিতা প্রমাণিত হলে চুক্তি ভেঙে যাবে।

চুক্তি যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে বর্তমানে ইইউ, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির কাছ থেকে যে সাহায্য–সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে, তা রাতারাতি বন্ধ হয়ে যাবে। ইরানের কট্টরপন্থীরা মধ্যপ্রাচ্যে এখন যেসব বিপ্লবধর্মী অভিযান চালিয়ে বেড়াচ্ছে, এই তিন দেশ তখন তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করবে। আর চুক্তিতে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের উপস্থিতি নিয়ে ইইউ তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করবে না।

অন্যদিকে, চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পর ইরান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের হাত আরও লম্বা হয়েছে। ট্রাম্পের বেরিয়ে আসার কারণে ইরান চুক্তি ভেস্তে যায়নি। কিন্তু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কারণে এখন যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু কার্যক্রমের অজুহাত দেখানো ছাড়াই ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে।

ইরানের কট্টরপন্থীরা এই চুক্তি থেকে বের হবে না—এর পেছনে বেশ কয়েকটি যৌক্তিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, তারা জানে শুধু রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল থেকে ইরান অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে পারবে না। ইরান চুক্তির সঙ্গে থাকা অন্তত তিনটি ইউরোপীয় দেশ সম্প্রতি সিরিয়ায় বিষাক্ত গ্যাস হামলা ও ইন্টারনেটে হস্তক্ষেপ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়েছে। সে কারণে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে চাপে আছে রাশিয়া। এ কারণে ইরান শুধু রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি সমর্থনের ওপর ভরসা করে থাকতে পারে না।

একই সময়ে অ-পশ্চিমা দেশ চীনের কাছ থেকেও ইরান নিরঙ্কুশ সমর্থন পাওয়ার আশা করে না। তা ছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের তেমন কোনো প্রভাবও নেই। এই মুহূর্তে চীনের প্রধান কৌশলগত লক্ষ্য হলো বিশ্বজুড়ে নিজের উপস্থিতি মেলে ধরা। সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেনসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে রাখার জন্য ইরান যেসব তৎপরতা চালাচ্ছে, সেটি চীনের সেই লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করছে।

চীন কোনো দেশের সঙ্গে অংশীদারের সম্পর্ক স্থাপন করতে গেলে প্রথমেই সে নিশ্চিত হয়ে নেয়, সেই দেশের মধ্যে দুটি বৈশিষ্ট্য আছে কি না। না থাকলে চীন সেদিকে এগোয় না। প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো, ওই দেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সহাবস্থান থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, ওই দেশে অবশ্যই এমন একটি সরকার থাকতে হবে, যা অজনপ্রিয়তার কারণে বা প্রতিপক্ষের হামলায় সহজেই শেষ হয়ে যাবে না। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকায় এই দুই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দেশ বেশি। সে কারণে চীন সেদিকেই পাখা মেলছে। টেকসই সরকারের শর্ত ইরান হয়তো পূরণ করতে পারবে, কিন্তু প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার সহাবস্থানের বিষয়টি খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। অন্যদিকে, ইরানকে চীন তার মধ্যপ্রাচ্যে ঢোকার পথের অন্তরায় হিসেবে গণ্য করছে।

ট্রাম্পের চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণার কারণে প্রেসিডেন্ট রুহানির পক্ষে এখন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংস্কারকাজ এগিয়ে নেওয়া বেশ দুরূহ হবে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁকে নিষ্ক্রিয়ও থাকতে হতে পারে। এই নিষ্ক্রিয়তা চলতে থাকলে ইরানের বেশির ভাগ জনগণের ওপর অর্থনৈতিক চাপ আরও বাড়তে থাকবে। আগামী বছরগুলোতে ইরান সরকারকে শুধু অপুষ্ট অর্থনীতির মধ্যে থাকা জনগণের চাপের মুখে পড়তে হবে, শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররাও তাকে চরম চাপে রাখার চেষ্টা করবে। সেই অবস্থা থেকে রেহাই পেতে হলে ইরান চুক্তির ভেতরে থেকেই তেহরানকে বুদ্ধি খাটিয়ে চলতে হবে।

Add a Comment