উদ্যোক্তা-বিনিয়োগকারীর পথ সুগম করুন

প্রথম আলো, ০৭ মে ২০১৮
মুনির হাসান: প্রথম আলোর যুব কর্মসূচি সমন্বয়কারী


২০১৮ সালের এপ্রিল মাস বাংলাদেশের কারিগরি উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সাফল্যের মাস। বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং খাতের অন্যতম উদ্যোগ ‘বিকাশ’-এ বিনিয়োগ করেছে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘আলিবাবা’র পেছনের প্রতিষ্ঠান ‘অ্যান্ট ফিন্যান্সিয়াল’। বিকাশের ২০ শতাংশ শেয়ারের মালিক হয়েছে এই চীনা কোম্পানিটি। এর আগে বিকাশে বিনিয়োগ করেছে ধনকুবের বিল গেটস ও মেলিন্ডা গেটসের প্রতিষ্ঠান বিল-মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং বিশ্বব্যাংকের সহায়ক প্রতিষ্ঠান আইএফসি।

দ্বিতীয় সুখবরটি দিয়েছে বাংলাদেশি ‘রাইড শেয়ারিং’ সেবা সংস্থা ‘পাঠাও’। বর্তমানে প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল শেয়ারিং সেবা থাকলেও এটি বেশি জনপ্রিয় হয়েছে তার মোটরসাইকেল শেয়ারিং সেবার জন্য। দ্বিতীয় দফায় বিনিয়োগ সংগ্রহ করার সময় পাঠাও-এর বাজারমূল্য হয়েছে ৮২০ কোটি টাকা। আর এই হিসাবে সেখানে একটি চীনা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে ১ কোটি মার্কিন ডলার, যা ৮২ কোটি টাকার কাছাকাছি।

দুটি ঘটনাই আমাদের তরুণ উদ্যোক্তা ও বাংলাদেশ সরকারের জন্য আনন্দ ও আস্থার প্রতীক। এই বিনিয়োগ প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের কারিগরি উদ্যোগে বিনিয়োগ করার পরিস্থিতি আছে এবং এখানে বিনিয়োগ করাটা বিবেচনার যোগ্য। দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানে বিদেশি বিনিয়োগের এমন ঘটনা সম্প্রতি অনেক বেড়েছে। কয়েক মাস আগে দেশীয় স্টার্টআপ অগমেডিক্স বাংলাদেশেও আমরা বড় অঙ্কের বিনিয়োগ লক্ষ করেছি। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে এ ধরনের বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি পাবে।

এ কথাটা অনস্বীকার্য যে, যদি এমনতর প্রতিষ্ঠানে দেশি ধনকুবেররা বিনিয়োগ করতেন, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগের হার ও পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যেত। তারই খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম, দেশে এ রকম উদীয়মান উদ্যোগে বিনিয়োগের তেমন কোনো পরিবেশ নেই। সাধারণত এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে ভেঞ্চার বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের পরিবর্তে উদ্যোগের শেয়ারের বিনিময়ে বিনিয়োগ করে এবং সুবিধাজনক সময়ে নিজের শেয়ার লাভসহ বিক্রি করে দেয়। যেহেতু খুঁজে খুঁজে বিনিয়োগ করা ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পক্ষে সম্ভব হয় না, সেহেতু তাঁরা তহবিল ব্যবস্থাপক (ফান্ড ম্যানেজার) খোঁজেন। এই ফান্ড ম্যানেজাররাই ভেঞ্চার বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান। আমেরিকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রাণকেন্দ্র সিলিকন ভ্যালির উত্থানের পেছনের অন্যতম বড় ভূমিকা হলো এই ভেঞ্চার কোম্পানিগুলোর।

কিন্তু বাংলাদেশে ভেঞ্চার কোম্পানি গড়ে তোলা নানা কারণেই কঠিন। একটি কারণ হলো ত্রিমাত্রিক করব্যবস্থা। দেখা যায় যিনি বা যাঁরা ভেঞ্চার কোম্পানিতে বিনিয়োগের জন্য অর্থ দিচ্ছেন, তাঁরা এক দফা আয়কর দেওয়ার পর সেটা দেন। এরপর এই অর্থ বিনিয়োগ হয় পাঠাও বা বিকাশের মতো কোনো প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানটিও যথারীতি আয়কর প্রদান করে। এরপর তাদের আয়ের টাকা বা তহবিল ভেঞ্চার কোম্পানি হয়ে যখন আবার বিনিয়োগকারী ফেরত পান, তখনো তাঁকে আবার আয়কর দিতে হয়। ফলে ত্রিমুখী আয়করের ঝামেলায় কেউ যেতে চান না। এ ছাড়া ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানগুলো মাত্র এ দেশে কার্যক্রম শুরু করেছে। এই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসাটির একটি স্থিতিশীলতা আসতে সময়ের প্রয়োজন।

কাজেই আমরা যদি মনে করি, আমাদের তরুণদের উদ্যোগে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করুক, তাহলে আমাদের এই ত্রিমাত্রিক বিনিয়োগ ও ভেঞ্চার ফান্ড ম্যানেজারদের কাজকর্মকে কোমল দৃষ্টিতে দেখতে হবে। এর মধ্যে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের আয়কে করমুক্ত করা হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। তবে তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ স্ট্যাম্প ডিউটির একটা ব্যাপার এখনো রয়ে গেছে। ফলে কোনো ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠান যদি ৫০ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করে, তখন তাকে বিনিয়োগ করার আগেই ১ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়।

আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, যদি আমেরিকার শেয়ারবাজারে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য আমাদের দেশের মতো ২০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন প্রয়োজন হতো, তাহলে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনবান কোম্পানি-অ্যাপল, মাইক্রোসফট বা ফেসবুকের মতো কোনো কোম্পানি আদৌ পাওয়া যেত কি না, কে জানে।
আমাদের দেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের একটি বড় সমস্যা হলো, তাঁরা কখনো শেয়ারবাজার থেকে প্রয়োজনীয় মূলধন তুলতে পারেন না ‘২০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন’ শর্তের কারণে। আমার নিজের বিশ্বাস, এই মূলধনি শর্তটি যখন জুড়ে দেওয়া হয়, তখন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানি ও তার বিকাশের কথা আমাদের জানা ছিল না।

জানা ছিল না, কেবল মেধাকে পুঁজি করে অনেক বড় অঙ্কের কোম্পানি গড়ে তোলা যায়। মোবাইল ফোনে মেসেজিং ও কথা বলার সফটওয়্যার হোয়াটস অ্যাপের কথা বলা যায়। মাত্র ৫৫ জনের এই কোম্পানিটিকে ফেসবুক কিনে নেয় ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার দিয়ে! আমাদের তরুণদের কাছে যদি আমরা তাদের সামর্থ্যের সেরাটা দেখতে চাই, তাহলে তাদের শেয়ারবাজারে ঢোকার একটি সহজ পথ করে দেওয়া দরকার।

বিনিয়োগের সহজ পথ নেই বলে আমাদের উদ্যোক্তাদের দৌড়াতে হয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকে। আর বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এখনো ‘সম্পদ’ বলতে ‘স্থাবর’ সম্পত্তিই বোঝে। মেধা ও দক্ষতাকে ‘সম্পদ’ হিসাবে গণনা করার কোনো পদ্ধতি তারা জানে না। একটি সফটওয়্যার কোম্পানি বা কলসেন্টারের মূল সম্পদ হলো তার দক্ষ কর্মী, যাঁরা রাত হলে বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। তাঁদের হিসাব যত দিন আমরা করতে শিখব না, তত দিন কেমন করে আমরা ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশ দেখব?

প্রতিবছর দেশে ২২ লাখ তরুণ-তরুণী কর্মবাজারে প্রবেশ করছেন। সরকারি হিসাবেই আমরা বছরে মাত্র ১৩ লাখ কর্ম সৃজন করেছি। কাজেই আমাদের বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, দেশের ৪ কোটি ৮২ লাখ লোক কোনো কাজ করে না! একা সরকার কিংবা কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এই কর্মসংস্থান সম্ভব নয়।

বিপুল কর্মসংস্থান একমাত্র তখনই সম্ভব, যদি এই বিপুল তরুণ-তরুণীর ৫ থেকে ৭ শতাংশ নিজের কর্মসংস্থান নিজে করে, যদি তারা ‘চাকরি না খুঁজে চাকরি দেয়’। আর সেটি সম্ভব হবে, যদি আমরা তাদের জন্য উদ্যোক্তাবান্ধব একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে পারি। বলা বাহুল্য, এমন কাজের সূচনা হতে পারে কেবল একটি উদ্যোক্তাবান্ধব বাজেটের পথ ধরে।

The End

Add a Comment