ছিটমহলের আদ্যপান্ত

ছিটমহল কি? (What is enclave?)
ছিটমহল দ্বারা এমন অঞ্চল বা ভূখণ্ডকে বোঝায় যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অবস্থিত অন্য কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত এলাকা। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই অন্য রাষ্ট্রের এ ধরণের ছিটমহল রয়েছে। ২০১৫ সালের ০১ আগষ্টের পূর্বে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের সর্বমোট ১৬২ টি ছিটমহল ছিল। ০১আগষ্ট রাত ১২:০১ মিনিটে দুই দেশ ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আওতায় একে অন্যের অভ্যন্তরে থাকা নিজেদের ছিটমহলগুলো পরস্পরের সাথে বিনিময় করে। বাংলাদেশ পেল লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি, নীলফামারীতে ৪টিসহ মোট ১১১টি ছিটমহল । অপরদিকে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অবস্থান ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এর মধ্যে ৪৭টি কুচবিহার ও ৪ টি জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত ছিল।

দাশিয়ারছড়া
এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ছিটমহল ছিল বাংলাদেশের কুড়িগ্রামে ভারতের ছিটমহল দাশিয়ারছড়া। দাশিয়ারছড়ার ভেতরেই আছে চন্দ্রখানা নামের বাংলাদেশের একটি ছিটমহল যেটি বাংলাদেশেই থেকে যায়। এটিই পৃথিবীর একমাত্র ছিটমহল ছিল যার অভ্যন্তরে অন্য দেশের আরেকটি ছিল।

দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ও দক্ষিন বেরুবাড়ী
খুব বিখ্যাত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলের নামটা অনেকেরই জানা – এই ছিটমহলটি বাংলাদেশের, কিন্তু এর চারিদিকে ভারতের এলাকা। ফলে এখানে থাকা লোকজন কার্যত জেলখানাতেই বন্দী। বহু দিন পর ১৯৯২ সালের ২৬ জুন ভারত ৩ বিঘা করিডোর ইজারা দিয়েছে। বিনিময়ে ভারত ১২ নম্বর দক্ষিন বেরুবাড়ী ইউনিয়নের দক্ষিনের অর্ধাংশ এবং সংলগ্ন এলাকার দখল পায়।

এই ছিটমহলের ইতিহাসটা কী?
একটা ব্যাপারে খুব ভালো মিল আছে – এই ছিটমহলগুলার অধিকাংশই প্রাচীন কুচবিহার রাজ্যের অংশ ছিলো। আর অনেকটা মোগল আমল থেকেই এই এলাকাগুলোর এই অবস্থা। জনশ্রুতি আছে, সেসময়ে কুচবিহার রাজ্যের রাজা, আর রঙপুর রাজ্যের রাজার মধ্যে পাশা খেলায় বাজির পুরস্কার হিসাবে এই এলাকাগুলা আদান প্রদান হতো। ফলে কুচবিহার রাজ্যের অংশ হয়ে পড়ে এমন অনেক এলাকা যা আসলে রঙপুরে, আর উল্টোটাও।

ছিটমহল সৃষ্টির কারন ?
১৯৪৭ সালে বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমারেখা টানার পরিকল্পনা করেন লর্ড মাউন্টবেটন। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল রেডক্লিফকে প্রধান করে সে বছরই গঠন করা হয় সীমানা নির্ধারণের কমিশন। ১৯৪৭ সালের ৮ জুলাই লন্ডন থেকে ভারতে আসেন রেডক্লিফ। মাত্র ছয় সপ্তাহের মাথায় ১৩ আগস্ট তিনি সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। এর তিন দিন পর ১৬ আগস্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় সীমানার মানচিত্র।

স্যার সিরিল রেডক্লিফ ভারত ও পাকিস্তানের মানচিত্র এঁকেছিলেন। যেসব এলাকা নিয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তান চিহ্নিত করেছিলেন তাই এখন বাংলাদেশের ভূখণ্ড। রেডক্লিফ সীমানা রেখা আঁকার সময়ে বাস্তব সমস্যা উপলব্ধি করেননি। ফলে বাস্তবে রেডক্লিফের সীমানা অনেক স্থানে হেরফের হয়। অনেক স্থানে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ভারতের দখলে এবং ভারতের ভূখণ্ড বাংলাদেশের দখলে থাকে। সেই দখলের স্থানগুলোকেই বলা হয় অপদখলীয় ভূমি।

নুন-নেহরু চুক্তি ১৯৫৮
দেশ বিভাগের এক বছরের মধ্যে ছিটমহল ইস্যু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চাপা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রকাশ ঘটায়। অবস্থা সামাল দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন কর্তৃক ১৯৫৮ সালে দু দেশের মধ্যে ছিটমহল দক্ষিণ বেরুবাড়ির (৭.৩৯ বর্গ কিমি) একটি অংশ পূর্ববাংলার কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিলে ভারতের বিরেধী রাজনৈতিক শিবির এর কঠোর বিরোধিতা করে। সিদ্ধান্ত ছিল যে, পূর্ববাংলার মূলভূমির সঙ্গে নীলফামারী জেলার পাটগ্রাম থানাধীন আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম ছিটমহলকে সংযুক্ত করতে ‘তিন বিঘা’ নামে খ্যাত এক একর জমির বিনিময়ে ভারত ছিটমহল সংলগ্ন অন্য এক খন্ড জমির অধিকারী হতে পারে। কিন্তু ভারতে এ নিয়ে লড়াই শুরু হলে এ সিদ্ধান্ত দু দশক সময়েও বাস্তবায়িত হতে পারে নি।

মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি ১৯৭৪
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি সই হয় ১৯৭৪ সালে যা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নামে পরিচিত। ওই সময়ে বাংলাদেশ চুক্তিটি অনুসমর্থন করলেও ভারত তখন তা করেনি। তারপর ২০১১ সালে সীমান্ত চুক্তির সঙ্গে সই হয় প্রটোকল। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রটোকলসহ সীমান্ত চুক্তি কার্যকর করতে ভারতের সংবিধান সংশোধন জরুরি হয় পড়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বর্তমান সরকার দেশটির পার্লামেন্টে সর্বসম্মতভাবে সংবিধান সংশোধনে সমর্থ হন। এরপরই প্রটোকলসহ সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পথ উন্মুক্ত ও ৩১ জুলাই মধ্যরাতেই সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন হয়।

অপদখলীয় ভূমি বিনিময়
সীমান্ত চুক্তির আলোকে দু’দেশের যৌথ জরিপ দল যার দখলে যে জায়গা রয়েছে সেটাকে ঠিক রেখে সীমানা রেখা খানিকটা ঘুরিয়ে দেন। ফলে সীমানার স্থানেও মানচিত্র পাল্টায়। এভাবে দেখা যাচ্ছে রেডক্লিফের মানচিত্রের আলোকে ছয়টি স্থানে ২২৬৭.৬৮২ একর ভারতীয় ভূমি বাংলাদেশ অপদখলীয় অবস্থায় ছিল। তাই এ চুক্তির ফলে বাংলাদেশ পায় ২২৬৭.৬৮২ একর জমি। তার বিপরীতে সীমান্তের ১২টি স্থানে ২৭৭৭.০৩৪ একর ভূখণ্ড ভারত অপদখলীয় রেখেছিল। যা এখন ভারতের দখলে।

অমিমাংসিত সীমানা
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি স্থলসীমান্ত রয়েছে। তার মধ্যে সাড়ে ছয় কিলোমিটার স্থলসীমান্ত অচিহ্নিত ছিল। দু’দেশের যৌথ জরিপ দলের সদস্যরা উত্তরাঞ্চলে দইখাদা এবং পূর্বাঞ্চলীয় লাঠিটিলায় সাড়ে চার কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত করেছেন। ফলে এ দুটি স্থানে মানচিত্র নিশ্চিত হল। তবে ফেনী জেলার বিলনিয়া সেক্টরে মুহুরীর চরে ২ কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। মুহুরী নদীর মধ্যস্রোতকে দুই দেশের সীমান্ত রেখা ধরা হয়। কিন্তু মধ্যস্রোতই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। ফলে সীমান্ত চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নের পথে এই সামান্য বাধাটুকু রয়ে গেল।

এদিকে মানচিত্র পরিবর্তন করে নতুন মানচিত্র প্রণয়নে দু’দেশের যৌথ জরিপ কর্মকর্তারা এগারশ’র চেয়ে বেশি স্ট্রিপ ম্যাপ প্রস্তুত করেন। সেগুলোতে সই করার জন্য ‘সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী’ (Plenipotentiary) ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ও বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ সই করেন। এই স্বাক্ষরের মাধ্যমেই নতুন মানচিত্র পেল বাংলাদেশ ও ভারত।

Add a Comment