গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র

যে শাসনব্যবস্থয় রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা সমাজের সকল সদস্য তথা জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকে, তাকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র(Democratic State) বলে। এটি এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে শাসনকার্যে জনগণের সকলে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং সকলে মিলে সরকার গঠন করে। এটি জনগণের অংশগ্রহণে, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের কল্যাণার্থে পরিচালিত একটি শাসনব্যবস্থা।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের মতপ্রকাশ ও সরকারের সমালোচনা করার সুযোগ থাকে। এতে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হয়। একাধিক রাজনৈতিক দল থাকে। সকলের স্বার্থরক্ষার সুযোগ থাকে এবং নাগরিকের অধিকার ও আইনের শাসনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ইত্যাদিসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা রয়েছে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার গুণ
গণতন্ত্রের অনেক ভালো দিক রয়েছে। নিচে গণতন্ত্রের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গুণ আলোচনা করা হলো।
১. ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে। সরকারের সমালোচনা করতে পারে। প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতার বিকাশ ঘটে। নাগরিকের অধিকার রক্ষা হয়।
২. দায়িত্বশীল শাসন: এ ব্যবস্থায় শাসকগণ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের নিকট দায়ী থাকে। তারা পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য জনস্বার্থমূলক কাজ করার চেষ্টা করে। ফলে দেশে দায়িত্বশীল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধি: গণতন্ত্রে জনগণের আস্থার উপর সরকারের স্থায়িত্ব নির্ভর করে। ফলে জনগণের আস্থা লাভের জন্য সরকার সততার সাথে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে। এর ফলে সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
৪. সাম্য ও সমঅধিকারের প্রতীক: গণতন্ত্রে সবাই সমান। এতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি নির্বিশেষে সবাই সমান সুযোগ বা অধিকার ভোগ করে এবং সবাই সমানভাবে রাষ্ট্রের কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে।
৫. নাগরিকের মর্যাদা বৃদ্ধি: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করে। নির্বাচনের মাধ্যমে সব নাগরিকের রাষ্ট্রের কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকায় তারা নিজেদের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে। এতে তাদের মধ্যে দেশাত্ববোধ সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
৬. যুক্তি ও সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত। কাজেই এতে শক্তি বা জোর করে কিছু করার সুযোগ নেই। বরং এতে জনগণের ইচ্ছা এবং যুক্তি প্রাধান্য পায়।
৭. রাজনৈতিক শিক্ষা লাভ: এতে রাষ্ট্রের শাসনকার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকায় নাগরিকগণ জটিল রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ পায়। নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য শুনে তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
৮. বিপ্লবের সম্ভাবনা কম: গণতন্ত্র নমনীয় শাসনব্যবস্থা। জনগণ ইচ্ছে করলে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন করতে পারে। ফলে এখানে বিপ্লবের প্রয়োজন হয় না।
৯. সরকারের প্রতি একাত্মতা বৃদ্ধি: গণতন্ত্রে জনগণ নিজেরাই শাসনকার্য পরিচালনা করে। ফলে তারা রাষ্ট্র ও সরকারকে নিজেদের মনে করে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ত্রুটি
অনেক গুণ থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের কিছু ত্রুটি আছে। নিচে এগুলো আলোচনা করা হলো।
১. গুণ বা যোগ্যতার চেয়ে সংখ্যার উপর গুরুত্ব প্রদান: গণতন্ত্রে নির্বাচনের মাধ্যমে জয়-পরাজয় নির্ধারণ করা হয় বলে এখানে গুণ বা যোগ্যতার চেয়ে সংখ্যার ওপর গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়। অর্থাৎ এতে মাথা গণনা করা হয়, মেধার বিচার করা হয় না।
২. দলীয় শাসনব্যবস্থা: এ ব্যবস্থায় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল সরকার গঠন করে। নির্বাচিত দল সব সময় নিজের দলের স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখে শাসনকার্য পরিচালনা করে। ফলে রাষ্ট্রে গণ-অসন্তোষ দেখা যায়।
৩. ব্যয়বহুল ও অর্থের অপচয় হয়: গণতন্ত্রে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন হয়। নির্বাচন পরিচালনায় প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। এছাড়া নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা নির্বাচনি প্রচারের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। নির্বাচনে জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য প্রতিটি দল লিফলেট, পোস্টার, জনসভা ইত্যাদি করে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। এতে সময়, সম্পদ ও অর্থের অপচয় হয়।
৪. ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন: গণতন্ত্রে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন হয়। গণতন্ত্রে নির্বাচিত দল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরকার গঠন করে এবং প্রতিটি দল তাদের নীতির ভিত্তিতে কর্মসূচি প্রণয়ন করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের কর্মসূচি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে সরকারের নীতিও পরিবর্তন হয়। ফলে কখনো কখনো রাষ্ট্রের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

গণতন্ত্র সফল করার উপায় ও গণতান্ত্রিক আচরণ

  • গণতন্ত্র বর্তমান যুগে প্রচলিত শাসন ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট এবং সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা। কিন্তু এর চর্চা বা বাস্তবায়নের পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য প্রয়োজন শিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠী, অর্থনৈতিক সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, দক্ষ প্রশাসন এবং উপযুক্ত নেতৃত্ব। এ ছাড়া আরও প্রয়োজন পরমতসহিষ্ণুতা, আইনের শাসন, মুক্ত ও স্বাধীন প্রচারযন্ত্র, একাধিক রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক সহনশীলতা। তবে সবচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন তা হলো, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন হতে হবে। তাদেরকে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক আচরণ করতে হবে। এজন্য যা করা প্রয়োজন তা হলো- নাগরিকদের পরমতসহিষ্ণু হতে হবে। সবাইকে মত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করতে হবে এবং অধিকাংশের মতামতকে সবার মতামত হিসেবে মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। নিজের বা নিজ দলীয় মতামত জোর করে অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
  • ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থপরতা পরিহার করতে হবে। এটি সকল নাগরিক ও রাজনৈতিক দলের জন্য প্রযোজ্য। কেবল বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করলে হবে না। দেশের মঙ্গলকে প্রধান্য দিয়ে কাজ করতে হবে।
  • নিজের অধিকার আদায়ের পাশাপাশি অন্যের অধিকারকে সম্মান করতে হবে। নিজের অধিকার আদায় যেন অন্যের অধিকার ভঙ্গের কারণ না হয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
  • বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং দলের মধ্যে সম্প্রীতি, সহযোগিতা ও সহনশীলতা বজায় রাখতে হবে।
  • ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে শ্রদ্ধা করতে হবে। সেই সাথে নাগরিকদের সুনাগরিকের গুণাবলি অর্জন করতে হবে। নাগরিকদের হতে হবে আত্মসংযমী ও বিবেকবান।
  • গণতন্ত্রের বাহন হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচন যেন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, সেজন্য নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে হবে। অযোগ্য লোক যেন নির্বাচিত হতে না পারে, সেজন্য নাগরিকদের সচেতনভাবে ভোট দিয়ে উপযুক্ত লোককে নির্বাচন করতে হবে। এতে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে।
  • আইনের শাসন হলো গণতন্ত্রের প্রাণ। এজন্য সবাইকে আইন মানতে হবে। আইনের চোখে সবাই সমান। অতএব, সকলের প্রতি সমান আচরণ করতে হবে। অর্থাৎ সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।

এসব গণতান্ত্রিক আচরণ শেখা ও তা প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য প্রতিটি নাগরিককে যত্নবান হতে হবে। তবেই প্রকৃত গণতন্ত্রের বিকাশ সম্ভব।


👉 Read More...👇

Add a Comment